রংপুরে বিদেশগামী শ্রমিকের হার কম: দালালচক্র নাকি সচেতনতার অভাব?

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫৭

বিদেশে কর্মসংস্থানের দিক থেকে রংপুর এখনো দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর একটি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশ থেকে যেখানে ৯৫ লাখ ৬২ হাজারের বেশি শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, সেখানে রংপুর জেলা থেকে গেছে মাত্র ৩৩ হাজার ১০৪ জন; সার্বিক হারে যা ০.৩৪ শতাংশের মতো।
বিদেশযাত্রার পথে বড় বাধা: দালালচক্রের দৌরাত্ম্য
দালালদের প্রলোভনে পড়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন রংপুরের অনেক শ্রমিক। মিঠাপুকুরের ঈসমাইল হোসাইন ৪ লাখ টাকা খরচ করে দুবাই পৌঁছালেও কোনো চাকরি না পেয়ে ফিরে আসেন দেশে। দুবাইয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে দুই মাস না খেয়ে জীবনযাপন করেছেন তিনি।
একইভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় তিন ভাই মিলে ৯ লাখ টাকা দেন আশরাফুল নামে এক যুবক। কিন্তু দালালের প্রতিশ্রুতি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, বিদেশ যাওয়া তো দূরের কথা টাকাও ফেরত পাননি তারা।
“প্রতারণার পর দালালরা বারবার সময় দিত, কিন্তু প্রতিবারই নতুন তারিখে ঠেলত। শেষমেশ কোনো কিছুই হয়নি,” বলেন আশরাফুল।
চিত্রে দেখা যাক রংপুর বনাম অন্যান্য বিভাগ (২০০৫-২০২২ সালের ভিত্তিতে)
বিভাগ মোট অভিবাসী (%)
চট্টগ্রাম ৩৯.০%
ঢাকা ২৯.৮%
সিলেট ৮.২%
খুলনা ৬.৬%
রাজশাহী ৬.২%
বরিশাল ৪.২%
ময়মনসিংহ ৩.৯২%
রংপুর ১.৮%
কম দক্ষতা, কম তথ্য, কম উৎসাহ
তিস্তা ইউনিভার্সিটির ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সবুজ সরকার বলেন,“কারিগরি শিক্ষার ঘাটতি ও বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির অভাব রংপুরের তরুণদের বিদেশে যাওয়ার পথে বড় বাধা। পাশাপাশি দালালদের দৌরাত্ম্য এই অনগ্রসরতাকে আরো জটিল করে তুলেছে।”
তিনি আরো বলেন, বিদেশযাত্রাকে নিরাপদ করতে হলে:
- প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন
- সরকারি প্রশিক্ষণ ও তথ্যসেবা কেন্দ্র
- বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রসার
- এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন জরুরি
কিছু আশার গল্পও আছে
পীরগাছার সাকিব খান শুভ সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে মালয়েশিয়ার একটি চীনা কোম্পানিতে কাজ করছেন দেড় বছর ধরে। তিনি বলেন, “সরকারি সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যাওয়া গেলে নিরাপদ অভিবাসন সম্ভব। আমি এখন ভালো আছি, নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছি।”
এছাড়া মাদ্রাসাশিক্ষিত কোরআনের হাফেজ তুহিন ও হাবিব সৌদি আরবে গিয়ে এখন পরিবারকে সাহায্য করছেন। তাদের বাবা ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, “বিদেশে শ্রমের দাম আছে, দেশে নেই। তাই সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়েছি। যদি সঠিক তথ্য ও সাপোর্ট পাওয়া যেত, আরো অনেকেই যেত।”
রেমিট্যান্সে রংপুর পিছিয়ে কেন?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, রংপুর বিভাগে রেমিট্যান্স প্রবাহ:
- ২০২০-২১ অর্থবছর: ৬৮৩.৬ মিলিয়ন ডলার
- ২০২৩-২৪ অর্থবছর: ৩০১.০৩ মিলিয়ন ডলার
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে: ১৭৭ মিলিয়ন ডলার
এখানে রেমিট্যান্সের প্রায় ৭৫% হ্রাস শুধু অভিবাসী সংখ্যা কমার কারণেই নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব ও অবৈধ পথে যাওয়া শ্রমিকদের আয় রেমিট্যান্স হিসেবে না আসার ফলেও।
সরকারি উদ্যোগে আশাবাদ
রংপুর কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক মো. নেশারুল হক বলেন, “আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সচেতনতামূলক সেমিনার এবং এজেন্সি অনিয়ম প্রতিরোধে কাজ করছি। দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ, নৈতিক ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনই আমাদের লক্ষ্য।”
রংপুরকে এগিয়ে নিতে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা
বিদেশে শ্রমিক পাঠানো শুধু অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, এটি একটি সামাজিক পরিবর্তনের অংশও। রংপুরের মতো পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে অভিবাসনের সম্ভাবনা বাড়াতে হলে— স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যকেন্দ্র, টার্গেটেড প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, দালাল প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তিনির্ভর রিক্রুটিং ও সহায়তা; এই চারটি স্তম্ভের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তথ্যসূত্র: এআই