
বাংলাদেশের কর্মীরা পৃথিবীর যেসব গন্তব্যে যায়, প্রায় একই গন্তব্যে কর্মী পাঠায় পাকিস্তানও। তারপরও রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকছে পাকিস্তান। ডিসকোভার ম্যাগাজিন ডট কমের সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, এ বছরের মার্চ মাসে পাকিস্তান তাদের ইতিহাসের মাসওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনতে পেরেছে। যার পরিমাণ ৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স আসা রেকর্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির ২৩০ শতাংশ বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে পাকিস্তানের।
অন্যদিকে, ২০২৫-এর মার্চে বাংলাদেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৩.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এক মাসে আসা রেমিট্যান্সের হিসাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর মার্চে পাকিস্তানে রেমিট্যান্স এসেছে ৪.১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। মার্চ, ২০২৫-এর হিসাবে বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ ২৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, জানুয়ারি, ২০২৫-এর হিসাবে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫.৬ বিলিয়ন ডলার।
কোন দেশের কত প্রবাসী?
প্রবাসীদের সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান অনেকটাই কাছাকাছি। বাংলাদেশের প্রবাসীর আনুমানিক সংখ্যা দেড় কোটি। বিপরীতে পাকিস্তানের প্রায় এক কোটি লোক প্রবাসী। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে। সেই সংখ্যা ৪৫ লাখের ওপর। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সেই সংখ্যা ৫০ লাখের ওপর।
তবে পাকিস্তানের জনশক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইতালিতে। এই চারটি উন্নত দেশে বাস করে পাকিস্তানের ২৫ লাখেরও বেশি প্রবাসী। পাকিস্তান এ বছরের মার্চে সৌদি আরব থেকে পেয়েছে ৯৮৭.৩ মিলিয়ন ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৮৪২.১ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৬৮৩.৯ মিলিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪১৯.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আর বাংলাদেশ এ বছরের মার্চে সৌদি আরব থেকে পেয়েছে ৪৪৮.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আমিরাত থেকে ৫০৮.৩৬ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৩৮৭.১৯ মিলিয়ন ডলার ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫৪৬.১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি রাষ্ট্রদূতের বরাতে জানিয়েছে, সৌদিতে আছেন প্রায় ৩২ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি। বিপরীতে দেশটিতে কাজ করেন প্রায় ২৭ লাখ পাকিস্তানি। কিন্তু সৌদি থেকে এ বছর মার্চে পাকিস্তানের আয় ৯৮৭.৩ মিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৪৮.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেখা যাচ্ছে, প্রায় কাছাকাছি প্রবাসী থাকা সত্ত্বেও কেবল দক্ষতার অভাবে ভালো চাকরি না পাওয়ার কারণে দেশের কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন কম। দেশে টাকাও পাঠাচ্ছেন পাকিস্তানিদের তুলনায় অর্ধেক।
এর বাইরেও আছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ, ফলে প্রবাসী আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশিই পাচ্ছে পাকিস্তান। যেমন-
সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষা
পাকিস্তান: পাকিস্তানি প্রবাসীদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ও প্রফেশনাল (ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইটি এক্সপার্ট, ব্যবসায়ী)। তারা উন্নত দেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। ফলে তাদের আয় ও প্রেরণ ক্ষমতা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ: অধিকাংশই ব্লু-কালার শ্রমিক; আয় সীমিত।
প্রজন্মের পরম্পরা
পাকিস্তান: প্রবাসী পাকিস্তানিদের প্রজন্ম পরম্পরার ইতিহাস এ ক্ষেত্রে বেশ প্রাচীন। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ প্রবাস ইতিহাস রয়েছে। ফলে তাদের দ্বিতীয়/তৃতীয় প্রজন্মের সন্তানরাও রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী এবং সক্ষম।
বাংলাদেশ: বড় স্কেলে প্রবাসী প্রবাহ শুরু হয়েছে ১৯৭০-এর দশক থেকে এবং এখনো তা মূলত শ্রমিককেন্দ্রিক।
ব্যাংকিং ও হুন্ডি প্রতিরোধ ব্যবস্থা
পাকিস্তান: পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি “Roshan Digital Account” ও অন্যান্য প্রণোদনামূলক স্কিম চালু করেছে, যাতে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হয়। এতে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
বাংলাদেশ: হুন্ডির ব্যবহার এখনো বেশি, ফলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক পথে আসে।
কারেন্সি দুর্বলতা
পাকিস্তান: ডলারের বিপরীতে রুপি দুর্বল হওয়ায় রেমিট্যান্সে উৎসাহিত হয় পাকিস্তানের মানুষ। রুপির অবমূল্যায়ন হলে প্রবাসীরা বেশি ডলার পাঠালে পরিবারগুলো আরো বেশি টাকা পায়- এটি রেমিট্যান্স পাঠানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ তৈরি করে।
বাংলাদেশ: বাংলাদেশেও এই প্রভাব আছে, তবে পাকিস্তানে এটি কিছুটা বেশি কাজ করে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে পাকিস্তানের প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। তারা উচ্চশিক্ষিত ও পেশাজীবী প্রবাসী। দক্ষতায় তারা বাংলাদেশিদের চেয়ে এগিয়ে। পাকিস্তানিদের মধ্যে হুন্ডির বদলে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা অনেক বেশি।
এমসি নিউজ ডেস্ক