বিশ্বজুড়ে বৈচিত্র্যময় নববর্ষ: ইরান থেকে আদিবাসী সমাজ, সবার আলাদা আয়োজন

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৬

নতুন বছর মানেই নতুন আশার আলো। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজস্ব ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। সময়, তারিখ কিংবা ধরন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক- পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো। নিচে তুলে ধরা হলো বিশ্বের কয়েকটি দেশের ও সম্প্রদায়ের নববর্ষ উদযাপনের চিত্র:
ইরান: নওরোজ- আলো ও নবজাগরণের উৎসব
ইরান ও পার্সি সংস্কৃতিভুক্ত দেশগুলোতে নববর্ষ মানেই নওরোজ। এটি উদযাপিত হয় বসন্তের প্রথম দিনে, সাধারণত ২০ বা ২১ মার্চ। প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব সূর্যপঞ্জির উপর ভিত্তি করে পালিত হয়।
ঘর পরিষ্কার, নতুন পোশাক পরা, বিশেষ খাবার ‘হাফত সিন’ টেবিলে সাজানো হয়; যেখানে সাতটি ‘স’ অক্ষরে শুরু হওয়া বস্তু থাকে। এটি নতুন জীবনের প্রতীক। নওরোজ শুধু ইরানেই নয়, আফগানিস্তান, কুর্দিস্তান, তাজিকিস্তান, এমনকি ভারতের পার্সি সম্প্রদায়ের মাঝেও পালিত হয়।
ভারত: বৈচিত্র্যে ভরপুর নববর্ষ
ভারতের নববর্ষ একেক রাজ্যে একেক নামে পরিচিত এবং বিভিন্ন সময় উদযাপিত হয়। পাঞ্জাবে উদযাপিত হয় বৈশাখী, যা কৃষকদের প্রধান উৎসব। মহারাষ্ট্রে উদযাপিত হয় গুডি পদওয়া এবং পশ্চিমবঙ্গে উদযাপন হয় পয়লা বৈশাখ। আসামে উদযাপিত হয় রঙালী বিহু আর কেরালায় বিশু। প্রতিটি অঞ্চলের নববর্ষে থাকে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, মেলার আয়োজন, ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও খাবার।
বাংলাদেশ: পহেলা বৈশাখে বাঙালির প্রাণের উৎসব
বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় নববর্ষ হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। সারাদেশে মানুষ হালখাতা করে, পান্তা-ইলিশ খায় এবং লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপন করে। গান, নাচ ও মেলায় অংশ নেয়। এই দিনটি ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালিয়ানা ও সম্মিলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চীন: চন্দ্র নববর্ষ, লাল আলোয় ভরপুর রাত
চীনা নববর্ষ বা স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল চন্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে উদযাপিত হয়। এটি চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব। পুরো পরিবার একত্র হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে, লাল ল্যান্টার্ন ও আগ্নেয়াতিশক্তি প্রদর্শন হয় এবং বয়স্করা ছোটদের লাল খাম (হংবাও) উপহার দেয়। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট চায়নিজ রাশির নামে পরিচিত হয়। যেমন ড্রাগন, টাইগার, র্যাট ইত্যাদি।
ব্রাজিল: সাদা পোশাকে সমুদ্র দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা
ব্রাজিলের নববর্ষ মূলত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে উদযাপিত হয়, তবে এতে মিশে আছে আফ্রিকান-ভিত্তিক ধর্ম ক্যান্ডোম্বলের প্রভাব। মানুষ সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে ইয়েমানজা দেবীকে ফুল ও উপহার অর্পণ করে। অনেকেই সাদা পোশাক পরে সাতটি ঢেউয়ের ওপর লাফিয়ে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করে। রিও ডি জেনেরিওর কপাকাবানা সৈকতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয়।
জাপান: ওশোগাতসু
জাপানে নববর্ষকে "ওশোগাতসু" বলা হয়। এই সময়ে বৌদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টা ১০৮ বার বাজানো হয়, যা পৃথিবীর ১০৮টি লোভ দূর করার প্রতীক। পরিবারগুলো ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন ওসেচি রিওরি প্রস্তুত করে এবং ঘর পরিষ্কার করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।
জার্মানি: ব্লেইগিসেন
জার্মানিতে "ব্লেইগিসেন" নামক একটি প্রথা রয়েছে, যেখানে সিসা গলিয়ে ঠান্ডা পানিতে ফেলা হয়। তাতে যে আকৃতি তৈরি হয়, তা নতুন বছরের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
স্পেন: আঙুর খাওয়ার রীতি
স্পেনে রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ১২টি আঙুর খেয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। প্রতিটি আঙুর একটি করে মাসের প্রতীক এবং এটি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
আদিবাসীদের নববর্ষ: প্রকৃতির সঙ্গে পুনর্মিলনের উৎসব
বিশ্বের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীও নিজস্ব ক্যালেন্ডার ও ঋতুচক্র অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপন করে:
- চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের "বিজু" বা "সাংগ্রাই" হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের নববর্ষ উৎসব। এতে ফুল ভাসানো, জলকেলি ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন হয়।
- উত্তর আমেরিকার নেটিভ আমেরিকানরা গ্রীষ্মকালীন সূর্যাস্তবিন্দুতে ‘Sun Dance’ বা সূর্য নৃত্যের মাধ্যমে বছরের সূচনা করে।
- আফ্রিকার কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় ‘Harvest Festival’-এর মাধ্যমে কৃষিকাজের নতুন চক্রকে নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করে।
নববর্ষ কেবল একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, আবেগ ও সম্মিলনের উপলক্ষ। প্রতিটি জাতি, ধর্ম ও গোষ্ঠী নববর্ষকে ব্যবহার করে পুরোনো দুঃখ ভুলে নতুন আশায় বাঁচার অনুপ্রেরণা হিসেবে। বৈচিত্র্যের মাঝেও এই উৎসবের অন্তর্নিহিত বার্তা এক- নতুন সূচনা।
মাইগ্রেশন কনসার্ন ডেস্ক