সাক্ষাৎকারে ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট কাউসার খান
অস্ট্রেলিয়ায় ভিসা কড়াকড়ির পরও সুযোগ বন্ধ হয়নি দেশের শিক্ষার্থীদের

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৩৬

কাউসার খান অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ও সাংবাদিক। দৈনিক প্রথম আলোর সিডনি প্রতিনিধি। অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশন, দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের কার্যক্রম নিয়ে তার লেখালেখির সাথে সুপরিচিত দেশের মানুষ। অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন, দেশটিতে স্টুডেন্টদের ভিসা কেন কমছে, কেন স্টুডেন্টদের ভিসায় যাচাই-বাছাই বেশি হচ্ছে, বিজনেস মাইগ্রেশন কেন প্রায় বন্ধের পথে, কেন ভিজিটর ভিসা কমছে, পড়াশোনা করে কীভাবে দেশটিতে স্থায়ী হওয়া যায়; স্কিলড ইন ডিমান্ড ভিসায় বাংলাদেশ থেকে কাদের পিআর পাওয়ার সুযোগ আছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে। কাউসার খানের ইন্টারভিউ নিয়েছেন মাহবুব স্মারক। চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ প্রথম পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : কাউসার খান আপনাকে স্বাগত মাইগ্রেশন কনসার্নের নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে। কোভিড সংকট কেটে যাওয়ার পর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভিসা দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ থেকেও বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভিসা পেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গেল ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়া শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়া কমিয়ে দিয়েছে। অর্ধেকে নেমে এসেছে ভিসা দেয়ার হার। এমনটা কেন হয়েছে এখন? দেশটি কেন শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়া কমাচ্ছে?
কাউসার খান : আপনাকে ধন্যবাদ। এই যে বলছেন অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষার্থী অর্ধেক নেমে যাওয়ার বিষয়টি সত্য। কোভিডের পর পর অস্ট্রেলিয়ায় অনেক সংকট ছিল। তারা তখন ঢালাওভাবে ভিসা দিচ্ছিল। ওই সময় যারা অ্যাপলাই করেছে, তারা সবাই মোটামুটি ভিসা পেয়েছে। তারপর অস্ট্রেলিয়া সরকার দেখল, এখানের যে ক্যাপাসিটি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্টুডেন্টদের ভিসা দেয়া হচ্ছে এবং স্টুডেন্টরা অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার ফলে আবাসন সংকটসহ আরো নানা সংকট শুরু হয়ে যায়। তখন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ সরগোল শুরু করে। তারপর সরকার দ্রুত এই ভিসা দেয়া কমিয়ে এনেছে। এটা কেবল বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রেক্ষাপট না, সারা বিশ্ব থেকেই তারা স্টুডেন্ট নেয়া কমাচ্ছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: সেটা বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের জন্য কতখানি চাপ তৈরি করেছে?
কাউসার খান : তবে আমি এটাও বলব, এমন ভিসা দেয়া কমিয়ে দেয়ার পরও বাংলাদেশ ভালো সুবিধায় আছে। বাংলাদেশ থেকে শুধু কলেজ লেভেলে আসতে পারছে না কিন্তু ইউনিভার্সিটি লেভেলে এখনো আমার জানামতে, পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে বাংলাদেশ থেকে যে কম আসছে তা না। কিন্তু আগে যেটা ছিল আমাদের যেটা দরকার যে বাংলাদেশ থেকে যে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসাটা এটা একটু কমে গেছে। ফিন্যান্সিয়াল কাগজ এটা একটু বেশি চাইছে। একটু কঠিন মনে হচ্ছে। আমি যেটা জানি ভেতর থেকে, তারপরও বাংলাদেশি স্টুডেন্ট কিন্তু প্রচুর আসছেন।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : আপনি বলছিলেন যে এখন অস্ট্রেলিয়ান ইমিগ্রেশন স্টুডেন্টদের কাগজপত্র আরো বেশি করে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে দেখছে… সেটা যদি একটু খোলাসা করে বলতেন, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা সতর্ক হতে পারে।
কাউসার খান : এটা হলো সরকারের সব সময় একটা ডিরেকশন থাকে, রিকোয়ারম্যান্ট তো থাকেই। তারপরও বিষয়টি কতখানি সহজ করে দেখবে আর কতটুকু কঠিন করে দেখবে, সেটা সব সরকারের ইন্টারনাল ডিরেকশন থাকে। যখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা স্টুডেন্ট বেশি নেবে তখন দেখা যায়, কেউ ধরেন ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট জমা দিল, সেটা তারা দ্বিতীয়বার আর চেক করে না। এটা ইজিই থাকে। কিন্তু যখন কঠিন হয়, তখন খুবই স্ক্রুটিনি করে, ব্যাংকের সাথে কথা বলে। মানে কোনো একটা ক্রুটি যদি ধরা পড়ে, তাহলেই এটাকে বাতিল করে দেয় বা ভিসা রিজিউজ করে। এটা আসলে সিম্পল, অস্ট্রেলিয়া সরকার সব সময়ই এটা করে থাকে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : সে ক্ষেত্রে কোন ধরনের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাটমেন্ট অস্ট্রেলিয়া দেখতে চাইছে? স্টুডেন্টের মা-বাবার একাউন্টের টাকা বা স্টুডেন্টের নিজের একাউন্টের টাকা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে দেখা হচ্ছে? আগে তো আত্মীয়স্বজনের টাকাও দেখানো যেত।
কাউসার খান : আপনাকে একটা কথা বলি, আসলে আইনটা এমনই ছিল। আসলে কী, মা-বাবার যদি ১০০ টাকা থাকে, তাহলে তারা সন্তানের জন্য ১০০ টাকাই খরচ করবে। কিন্তু রিলেটিভের যদি ১০০ টাকা থাকে, তাহলে বিপদে পড়লে তারা ৫০ টাকা দেবে। এটা একটা বেসিক ধারণা। এই ধারণা আগেও ছিল, আগেও এভাবেই ভিসা দেয়া হতো। কিন্তু নির্দেশনার অভাবে কিন্তু যে কেউ টাকা দেখাতে পারত, তার আত্মীয়স্বজন করতে পারত। বাবা-মাও করতে পারতেন। এখন দেখা যাচ্ছে, স্ট্রংলি জেন্যুইন টেম্পোরারি এ্যানট্রেন্স দেখে। ফলে এটার মধ্যে ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে বাবা-মা যদি হয় বা নিজের কাছে যদি থাকে টাকাটা, তাহলে এটাকে মোর ক্লোজ মনে করে তারা। তাহলে তারা মনে করে যে তারে ভিসাটা দেয়া যেতে পারে। এটাই। বিষয়টি আসলে আগের মতোই আছে। এখন দেখে বাবা-মার টাকা-পয়সা আছে কিনা।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : এটাও তো শুনতে পাচ্ছি যে খুব ভালো রেজাল্ট, আইএলটিএস বা টোফেলে ভালো স্কোর না থাকলে ভিসা ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে? এটা কি সত্য?
কাউসার খান : এটা অসত্য বলব না। যেটা রিকোয়ারমেন্ট থাকে, অস্ট্রেলিয়ায় যেমন ইউনিভার্সিটি লেভেলে, আইএলটিএসে বা পিটিইতে সমমান ৬ থাকে। এ শর্ত পূরণ করলে ভিসা পাওয়ার কথা। জেনারেল ইম্প্রেশন বলেও তো একটা কথা আছে। যেমন ১০ জন স্টুডেন্ট অ্যাপ্লাই করে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো নয়ে নয় পাওয়া একটা ছেলে সে প্রাইয়োরিটি পাবে। কিংবা ইউনিভার্সিটিতে সে অ্যাপ্লাই করতে পারবে। ফলে সেই ইউনিভার্সিটি তাকে সহজে ভর্তি নেবে। এখন হচ্ছে কী, যেগুলো ভালো ইউনির্ভাসিটি নিজেরাই অ্যাসেসমেন্ট করে ডিপার্টমেন্টকে দেয়। এখন ইউনিভার্সিটিগুলো, যারা ভালো ইংরেজি জানে, তাদের ভিসা যাতে রিজিউজ না হয় সেই ধরনের ক্রাইটেরিয়া তারাই চেক করে। এ ক্ষেত্রে বড় বড় ইউনিভার্সিটিগুলা; যেমন মনাশ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস্, ম্যাককুইরি ইউনিভার্সিটি কিংবা সিডনি ইউনিভার্সিটি এ ধরনের যারা আট-দশটা বড় ইউনিভার্সিটি আছে, তারাই স্ক্রুটিটি করে তারাই অ্যাসেসমেন্ট করে। এসব ইউনিভার্সিটি থেকে যদি কেউ অফার লেটার পায়, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত যে ভিসা পাবে। তখন আর ডিপার্টমেন্ট আর কোনো জটিলতা করে না।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যারা অস্ট্রেলিয়া পড়তে যেতে চান, তাদের কী ধরনের প্রস্তুতি এই বাস্তবতায় নিতে হবে?
কাউসার খান : দেখেন, আমার একটা জিনিসে কষ্ট লাগে। সব ক্রাইটেরিয়া দেয়া আছে। এসব আসলে উচ্চবিত্তদের জন্য সিস্টেম করা। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই, আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যাতে অস্ট্রেলিয়ায় আসতে পারে। কিন্তু আসলে এসব নিয়মকানুন উচ্চবিত্তদের জন্য ফিট করে। ভালো টাকা-পয়সা থাকতে হবে মানে যেন সলভেন্ট হয়। এখানে এসে যেন ক্রাইসিসের মধ্যে তাদের পড়তে না হয়। তারা চায়, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে, সামান্য কাজ করে সে যেন চলতে পারে। এখানে যে পরিমাণ খরচ লাগে এটা কিন্তু একটা ভালো ফ্যামিলি ছাড়া হয় না। এগুলো বলতে আমার একটু কষ্ট লাগে। সেকেন্ড থিং হচ্ছে, ইংলিশ জানতে হবে, এটা একটা গ্লোবাল ক্রাইটেরিয়া।
মাইগ্রেশন কনসার্ন : তার মানে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে?
কাউসার খান : আমি বলব, টাকা-পয়সা যেটা মিনিমাম সেটা থাকতে হবে। আর ইংরেজির দক্ষতা স্টুডেন্টের ওপর নির্ভর করে। তারা যেন ইংরেজির দক্ষতা খুব ভালো করে নেয়। সে যে সাবজেক্টে পড়তে আসবে, সেটা যেন রিলেভেন্ট হয়। আর অস্ট্রেলিয়ায় যারা পড়তে আসে, তারা এটা মাথায় রেখে আসে, যেন তারা এ দেশে স্থায়ী হতে পারে। এমন যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সেটা খারাপ না যে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হতে চাওয়া। আর এখন তো পৃথিবী উন্মুক্ত। যে কোনো জায়গায় মানুষ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায় পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হতে গেলে যেসব সাবজেক্টে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির বেলায় ভালো প্রায়োরিটি দিচ্ছে, সেগুলো পড়া উচিত। সেটাতেই আমি জোর দিতে চাই।
চলবে…