
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২৮

অনন্য নন্দিতা স্থায়ীভাবে সুইডেনে বাস করেন।
আমার দুই মেয়েকে স্কুলে দেয়া দরকার। ইরাকি মালিক যথেষ্ট চড়া মূল্যে বাসা ভাড়া দিলেও ঠিকানা দিলেন না। যে ভাইয়ের ঠিকানা নিয়েছিলাম, তাঁর পৌরসভা আমার শহর থেকে বেশ দূরে । ওনার কাছে ক’দিন পরপরই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর নোটিশ আসছিলো। তাই উনিও বিরক্ত হয়ে বললেন ঠিকানাটা বদলে নিতে। ৬ মাস হয়ে গেলো, লুন্ডে ঠিকানার ব্যবস্থা করতে না পারায় বাচ্চারা আমার স্কুল পাচ্ছিলো না । অবশেষে আমাদের উপর তলায় থাকা এক সুইডিশ যুবককে অনুরোধ করে তার ঠিকানাটা চাইলাম, জানালাম আমার বাচ্চাদের কী পরিস্থিতি! সে হাসিমুখেই ঠিকানা দিতে রাজি হয়ে গেলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, তারপরও বাসা খোঁজার প্রক্রিয়া বহাল রইলো।
সুইডেনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ থাকলেও ভাষা না জানলে চাকরীর বাজারে নিজেকে যেনো অযোগ্য মনে হয়। তারপরও বাংলাদেশী মালিকানাধীন এক ভারতীয় রেঁস্তোয়ায় ওয়েট্রেসের কাজ মিললো। পাশাপাশি একটি শপিংমলের ফুডকোর্টেও কাজ পেলাম। ইংরেজি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছিলাম বেশ। যে টাকা মিলতো তাতে খুব একটা সুবিধা হচ্ছিলোনা। হাতের জমানো টাকাও ফুরিয়ে যাবার পথে। তার উপর নিজের দেশি ঐ মালিকদের ব্যবহার দেখে মনে হতো - যেনো দেশে উনারা রাজা বাদশা ছিলেন আর আমরা তাদের দাস! এধরনের আচরন সুইডিশ স্যোশাল সিস্টেম গ্রহনযোগ্য নয়। তবে দুর্যোগের সময় কাজ দিয়ে উপকার করেন বলেই ওনাদের নামে কোনো অভিযোগ করেননা কেউ। কর্মি নিয়োগে অবশ্য উনাদের লাভের ভাগটাই বেশি।কেউ অভিযোগ না করার সুযোগে আইন ফাঁকি দিয়ে অনেক কিছুই করে ফেলন তারা !
অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেশিরভাগ কর্মীই নিশ্চুপ কাজ করে যান। অসততার ওপর আমার বরবরের বিতৃষ্ণা খানিকটা প্রতিবাদী করে তোলে আমাকে । ফলস্বরুপ আমার কাজটা চলে যায়। তাতে কি? আমি জানতাম, একদিন আমি জিতবই আর হেরে যাবার সুযোগও আমার নেই।তবে জেতার সেই পথটা অনেক কঠিন হবে জেনেই এ পথে পা দিয়েছিলাম । তাই বলে কোনো অসৎ উপায়ে নয়। লেখাপড়ার চাপের মধ্যেও নতুন আরেকটা কাজ আর বাচ্চাদের জন্য একটা নিরাপদ বাসার খোঁজে আমি ওঠেপড়ে নামলাম।
সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজধানী মালমোতে থাকা এক বড় আপা আর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হলো রেস্তোরার এক সহকর্মীর বদৌলতে। লুন্ডের এক প্রতিষ্ঠিত হোটেলে চাকরীরত ওই ভাই বললেন উনাকে একটা সিভি পাঠাতে । আমিতো বিশাল ফরমাল একটা সিভি ওনাকে মেইল করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনার কল এলো । বললেন- নন্দিতা, ‘কামলা’ সিভি পাঠান! আমি থতমত খেয়ে গেলাম! ‘কামলা’ সিভি আবার কি? বললাম ভাই একটা নমুনা পাঠান। যাই হোক নমুনা অনুসরন করে আধা পাতার একটি সিভি বানালাম। প্রথমবারের মতো বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠলো ।নিমিষেই আমার সিভির পাতা থেকে ডিলিট হয়ে গেলো এড্যুকেশন ব্যাকগ্রাউন্ড আর চাকরী অভিজ্ঞতার দুই তৃতীয়াংশই । যেই সিভির ওজন বাড়াতে জীবনের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শুধু বই নিয়েই পরে থাকতে হয় আমাদের মতো উন্নয়শীল দেশগুলোর ছেলেমেয়েদের, তার মুল্য নেই এই সমাজে?! এমন ভাবনা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো।
ওই হোটেলে হাউসকিপিং এর কাজ মিললো । বড় বড় বিছানার চাদর বদলানো, টয়লেট পরিস্কার, রুম ক্লিনিং সবই করছিলাম পুরোদমে।কয়দিন যেতেই হাতে ব্যাথা, এলার্জিও বেড়ে গেলো । বস আমার কাজে ব্যাপক খুশি হয়ে বললেন, ফুডকোটের কাজটা তুমি ছেড়ে দিতো পারো, সংসার চালানোর মতো টাকা তোমার চলে আসবে এই কাজ থেকেই । আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আপাতত উপার্জনের ঝামেলা মিটলো।রেস্তোরার কাজটা ছেড়ে দিলাম।
চলবে…
অনন্য নন্দিতা স্থায়ীভাবে সুইডেনে বাস করেন। দেশে তিনি একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ও নিউজ কাস্টার হিসেবে কাজ করতেন।