
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৪৪

অনন্য নন্দিতা স্থায়ীভাবে সুইডেনে বাস করেন।
১৯ জানুয়ারি বস্ আমার পারসোনাল ডিটেইলস্ নিলেন। চাকরীর কন্ট্রাক্ট এর জন্য যা লাগে আরকি। তারপরও আমি থেমে থাকলাম না। হয়তো ১০০ ভাগ আস্থা রাখতে পারছিলাম না অথবা সংকিত মনটায় তর সইছিলোনা। আমি আমার কমুনের সব প্রিন্সিপালকে পার্সোনাল ইমেইল পাঠাতে লাগলাম, এই বলে যে, তাদের কারো স্কুলকিচেনে কোনো লোক লাগবে কিনা। ২০ তারিখ সকালেই বসের ম্যাসেজ আসলো আমার ফোনে। কমিউনের স্কুল বিভাগের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের বস হওয়ায় উনার কাছে অটোমেটিক ওই খবর চলে গেছে, যে আমি সরাসরি চাকরির চেষ্টা করছি।তিনি আমাকে লিখলেন যে, আমার অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টার দরকার নেই। তিনি আমাকে ওনার বিভাগের জন্য সেট করতে চান। সেদিন বিকেলেই কনট্রাক্ট সই করতে যাওয়ার ফোন এলো। মনের মধ্যে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসা অন্জন দত্তের গানটা বেজে উঠলো “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো…” আমার জীবনে প্রেমিকা বেলা না থাকলেও, ফুটফুটে দুটো মেয়ে— যারা আমার এই কঠিন সংগ্রামে পথে সাথী হয়ে পাশে ছিলো। তাদের মায়ের এমন চাকরির খবর, কঠিন সে সময়ে, এরচেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে?
জানুয়ারির ৩১ তারিখ পুরোনো ওয়ার্ক স্টেশনের কাজ শেষ করে, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে স্কুলে ‘ভিকরি’ হিসেবে যোগ দিলাম। শব্দটা বাংলায় একটু বেমানান শোনালেও, কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন নির্দিষ্ট চাকরিরত ব্যক্তির পরিবর্তে কাজ করাকে এ নামেই ডাকা হয় এদেশে। তার মানে আমার চাকরীটাও একটা নির্দিষ্ট সময়সীমায় সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে, এভাবেই আমার বস আমাকে একটার পর একটা কন্ট্রাক্ট দিয়ে গেছেন।ততদিনে উনার সহযোগিতায় আমি পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পারমিটের জন্য আবেদন করে ফলাফলের অপেক্ষায়। এভাবেই প্রায় দুই বছর চলে গেলো । তখনো আমার চাকরি পার্মানেন্ট হয়নি। ২০২২ এর ডিসেম্বরে একদিন হঠাৎ করেই মাইগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা মেইল এলো।যাতে চাকরির সর্বশেষ অবস্থা ও আরো কিছু কাগজপত্র চেয়েছেন কেইস অফিসার। ওনার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে জানতে পারলাম কেবল ১৮ মাসের কন্ট্র্যাক্ট অথবা একটা পার্মানেন্ট চাকরিই আমাকে দিতে পারে PR বা সুইডেনে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ । তা না হলে যে কয় মাসের চাকরির কন্ট্যাক্ট আছে সে কয় মাসের এক্সটেনশন দেয়া হবে, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় বসবাসের অনুমতি । এর মধ্যে সরকার বদলেছে, দেশটিতে ক্ষমতায় এসেছে, অভিবাসন বিরোধী সরকার। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে । তাই মনের মধ্যে বাড়তি ভয় কাজ করছিলো।
চটজলদি করে বসকে ফোন দিয়ে জানালাম সে কথা।তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন, যদি আমার পার্মানেন্ট চাকরি পাওয়ার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে তাহলে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। তবে নীতির বাইরে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। সুইডেনে আসার পর, বিধাতা আমার উপর হয়তো বেশিই সদয় ছিলেন।যেখানে আমার দেশে নিয়মের মধ্যে থেকেও, সমমানের সুবিধা পাইনা সবাই সেখানে ভিনদেশি হয়েও নিয়মেই চাকরি হারিয়েছে আবার নিয়মের মধ্য দিয়ে পেয়েও যাবো, সে আস্থাই ছিলো আমার । কিছুক্ষণ পর তিনি জানালেন, নির্ধারিত ৫৪৮ দিনের থেকে কয়েকদিন বেশিই কাজ করেছি আমি। তাই ৯০ভাগ নিশ্চিত আমি থাকতেই পারি। সে দিনই কর্মী দরকার এমন ৪জন প্রিন্সিপালের কাছে ব্যক্তিগত ইমেইল করলেন তিনি। ইমেইল করলেন শ্রমিক ইউনিয়নেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য।দুইদিন পর, তিনি জানালেন দুইজন প্রিন্সিপাল আমাকে নিতে আগ্রহী।আগে কাজ করেছি এমন একজন সদয়ী প্রিন্সিপালের স্কুলটাই বেছে নিলাম আমি। চাকরির কাগজপত্র জমা দেয়ার কয়েক ঘন্টা পরই মেইল চলে আসে যে আমার কেইসের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে ।
তবে, কি সিদ্ধান্ত হয়েছে তা দেখা যাচ্ছিলো না। মনের ভেতরটা এক অজানা আতঙ্কে আনচান করছিলো।ঠিক সন্ধ্যায় আমার বস আমাকে ফোন করে জানালেন যে, আমার পজিটিভ সিদ্ধান্ত হয়েছে।অর্থাৎ সুইডেনের আমার আর আমার পরিবারের স্থায়ী বসবাসে আর কোনো বাধা নেই। আনন্দে তার গলা ভারি হয়েছিলো, আমিতো যেনো অনুভূতিহীন!
৫ বছরের অপরিসীম সাধনা আর প্রচেষ্ঠার সুফল মিললো। প্রায় দুই বছর নাগরিকত্বের আবেদন করে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম । তবে এখন আর মনের মধ্যে কোনো সঙ্কা নেই। কারন দেশে ফিরে যাবার ভয় আর তাড়া করে বেড়ায় না। এখন শুধু জীবনকে আরো সুন্দরভাবে গুছিয়ে নেয়ায় চেষ্টায় মগ্ন আমি। সন্তানদের জন্য একটা নিরাপদ জীবন, যেখানে আমি না থাকলেও, তাদের না খেয়ে মরতে হবেনা, লেখাপড়া চলবে নিয়মিত গতিতে- এমন নিশ্চিত হওয়ার পর আর ভাবনা কিসের?
অনুমতি ছাড়া কারো নাম উল্লেখ করা উচিত হবেনা।তাই এই লেখায় আমি কারো নাম উল্লেখ করিনি । আমার এই সফলতার পেছনে আছে দেশে বিদেশে, দেশি, বিদেশি অনেক প্রিয় মানুষের সহযোগিতা । যাদের ছাড়া আমি হয়তো কোনোদিনও সফল হতে পারতাম না।তাদের সবার কথা উল্লেখ আছে লেখায় । আমার বিশ্বাস, লক্ষ্যে অটল থেকে চেষ্টা চালিয়ে গেলে, পাওয়া যায় অনেক হৃদয়বান মানুষের সহযোগিতা।বিশ্বাস করুন, তাদের কারো নাম উল্লেখ না করলেও, তারা সবাই আছেন আমার হৃদয়ে।তাদের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
অনন্য নন্দিতা স্থায়ীভাবে সুইডেনে বাস করেন। দেশে তিনি একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ও নিউজ কাস্টার হিসেবে কাজ করতেন।